অপারেশন থিয়েটার দুনিয়ার সবচেয়ে জটিলতম যায়গা। মানুষের কষ্ট/যন্ত্রনা, জীবন/মরন নিয়ে এখানে খেলা চলে প্রতিনিয়ত। একজন রোগী যখন অপারেশন থিয়েটার এ থাকে তখন তার পরিবার ও আত্মীয় স্বজন অনেক উৎকণ্ঠা নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করেন। সময় যত গড়ায় তাদের উৎকণ্ঠাও তত বাড়তে থাকে, একসময় তারা সংকিত বোধ করেন- কোন সমস্যা হল কি না, এতো সময় লাগছে কেন?

অপারেশন থিয়েটার এর ভিতরে সার্জন এবং এনেস্থেসিয়া টিম ও তখন একটা চাপ অনুভব করেন- সার্জন চিন্তা করেন অপারেশন টা ঠিকঠাক হচ্ছে কি না আর এনেস্থেটিস্ট চিন্তা করেন রোগী ঠিক আছে কিনা! আমাদের দেশের রোগী ও তার স্বজনরা শুধু সার্জন কেই চিনে এবং তাদের ধারনা যে কোন জটিলতার জন্য শুধু সার্জন ই দায়ী। এতে অবশ্য এনেস্থেটিস্ট এর চাপ অনেকটা কমে যায়। এইটা ঠিক না। রোগীদের উচিত এনেস্থেটিস্ট কেও জানা। সার্জন এর একটা ভুল হয়তো পরবর্তী তে অপারেশন করে ঠিক করা যাবে কিন্তু এনেস্থেটিস্ট এর ভুল হলে আর সে সুযোগ পাওয়া যাবে না, জীবন শেষ হয়ে যাবে। আমি নিজে আমার ব্যাক্তিগত প্র্যাক্টিসে এনেস্থেটিস্ট নির্বাচন করি খুব সতর্কতার সাথে।

যাইহোক, মুল কথায় আসি। কিছুদিন আগে আমরা বড় একটা অপারেশন করেছিলাম। এক বছরের বাচ্চার টিউমার এর জন্য লিভার এর ডান অংশ কেটে ফেলে দিতে হয়েছিল। জটিল এই অপারেশন এর আগে আমি নিজে বাচ্চার বাবা মা কে ডেকে অনেক সময় নিয়ে অপারেশন এর সময় এবং এর পরবর্তী জটিলতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। অপারেশন শেষে বাচ্চার বাবার সাথে আমার কথোপকথন-

-স্যার, অপারেশন সাকসেস্ফুল?

– সাকসেস্ফুল তো এখনই বলা যাবে না, লিভারের বড় অংশটাই টিউমার সহ কেটে ফেলা হইছে, বাকি ছোট অংশ টা শরীরের সব কাজ ঠিকঠাক করতে পারবে কিনা এখনই তা বলা যাচ্ছে না।

– স্যার, তাহলে কি অপারেশন ভুল হয়েছে?

আমি কিছুক্ষনের জন্য তব্দা হয়ে গেলাম। আমাদের মিডিয়ার কল্যানে ‘ভুল অপারেশন’ শব্দটার প্রতি একধরনের এলার্জি তৈরি হয়েছে (আমার মনে হয় বেশির ভাগ সার্জনেরই তাই) । অপারেশন এর জটিলতা আর ভুল অপারেশন এক কথা নয়। যাইহোক, বাচ্চাটাকে আমরা কোনরকম জটিলতা ছাড়াই হাসপাতাল থেকে ছুটি দিতে পেরেছিলাম। অপারেশন সাকসেস্ফুল ছিল!!

যে কোন অপারেশন এর পর সার্জন যখন অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হন রোগীর স্বজন রা তখন জানতে চান- অপারেশন কি সাকসেস্ফুল? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কিন্তু ওই সময় খুবই কঠিন। আমাদের রোগী এবং তাদের স্বজন দের মানস পটে বাংলা সিনেমার সেই দৃশ্য টা সবসময়ই ভাসে- ডাক্তার অপারেশন শেষ করে অপারেশন থিয়েটার এর বাইরে এসে মুখে হাসি নিয়ে বলবেন – অপারেশন সাকসেস্ফুল!! কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি বাস্তবে বেশিরভাগ সময়ই এমনটা ঘটে না। বিশেষ করে বড় এবং জটিল অপারেশন এর ক্ষেত্রে। বাস্তবে সার্জন রা যা বলেন – অপারেশন ঠিক হয়েছে, রোগীর জ্ঞ্যান ফিরেছে, দেখা যাক কি হয়।

অনেকে প্রশ্ন করেন আমার রোগী কি এখন শংকা মুক্ত? বাস্তবে এই উত্তরটাও আশানুরুপ পাওয়া যায়না। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে রোগীর স্বজনদের বলি – ৪/৫ দিন এর আগে কিছু বলা যাবে না। যদিও আমি জানি যে রোগীর সব ঠিক আছে!

সাকসেস্ফুল অপারেশন বলতে যদি আমরা বুঝি যে জটিলতা মুক্ত অপারেশন তাহলে অপারেশন এর পরপরই এটা বলা অসম্ভভ যে অপারেশন সাকসেস্ফুল হয়েছে। কারন অপারেশন পরবর্তী জটিলতা গুলা ধীরে ধীরে বোঝা যায়, সেগুলো কে তখন নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা করতে হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন কি পুনরায় অপারেশন দরকার হয়। রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আন্তর্জাতিক ভাবে অপারেশন এর পর ৩০ দিন এর মধ্যে যদি রোগি একই রোগে মারা যায় তাহলে তাকে অপারেশন এর কারনে মৃত্যু (Post operative death) ধরা হয়। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে সাকসেস্ফুল অপারেশন বলতে হলে আপনাকে অনেক লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হবে!

খুব ছোট ছোট অপারেশনেও অনেক বড় জটিলতা হতে পারে। মনে করুন একটা হার্নিয়া অপারেশন। সার্জন খুব আত্মবিশ্বাস এর সাথে অপারেশন শেষ করে বলে দিলেন – অপারেশন সাকসেস্ফুল! কিন্তু পরেরদিন দেখা গেলো রোগীর নিউমোনিয়া!! এছাড়াও অপারেশন এর যায়গায় ইনফেকশন হতে পারে, অপারেশন ফেইল করতে পারে, ইমপ্ল্যান্ট/গ্রাফট রিজেক্ট হতে পারে। এর সবকিছুই বোঝা যায় অপারেশন এর কয়েকদিন পর থেকে!

আবার কোন কোন ক্ষেত্রে যে উদ্দ্যেশ্যে অপারেশন করা হয়েছে তা সফল হল কি না তা বুঝতে দিন/মাস এমনকি বছর লেগে যেতে পারে। বিশেষ করে আমাদের শিশু সার্জারির কিছু জটিল সমস্যা আছে যেগুলোতে আমরা কয়েক ধাপে অপারেশন করি। শেষ ধাপ ঠিক্ঠাক শেষ হওয়ারও অনেক পরে বোঝা যায় যে অপারেশন সাকসেস্ফুল হয়েছে কি না!

ধরা যাক, একটি বাচ্চার জন্মগতভাবে মলদ্বার নেই। এইসব ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিন ধাপে অপারেশন করতে হয়। দুই বছর বয়সের মধ্যে সব অপারেশন শেষ করার পরও আপনাকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে এইটা বোঝার জন্য যে এই বাচ্চাটা স্বাভাবিক পায়খানা করতে পারবে কি না। কারন স্বাভাবিক ভাবে ৩/৪ বছর বয়সের দিকে বাচ্চারা পায়খানা নিয়ন্ত্রন করতে পারে।

তাই, অপারেশন সাকসেস্ফুল হল কিনা ত জানতে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। আপনার নিজের বা নিকটজনের যদি কখনো অপারেশন দরকার হয় তা যেন সাকসেস্ফুল হয় এই কামনা করি।