২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা। রাজশাহী থেকে ইন্টার্নশীপ শেষ করে ঢাকায় এসেছি। উঠেছিলাম আগারগাও এর বিএনপি বাজারের পাশের একটা বিল্ডিং এ। ছয় জন বন্ধু মিলে একটা ফ্ল্যাটে থাকতাম। চাকরী নাই, ট্রেইনিং এও ঢুকি নাই। পরের জুলাই মাসে এফসিপিএস প্রথম পর্ব পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সকালে বিএসএমএমইউ এর লাইব্রেরীতে যাই, রাত নয় টার পর ফিরি। মাঝে মাঝে ঢাকার বাইরের কোন ক্লিনিকে ডিউটি করতে যাই, টানা ২/৩ দিন ডিউটি করে আবার ঢাকায় চলে আসি।
একদিন সন্ধ্যায় মিরপুরে ছোট মামার বাসায় যাই। সেখানে রাতের খাবার খেয়ে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ১১ টা বেজে গিয়েছিল। আগারগাও এর এরিয়া টা তখন এখনকার মত ছিলনা, পুরো এরিয়া টাই প্রায় বস্তি ছিল। শেওড়াপাড়া থেকে লেগুনায় এসে রেডিও অফিসের সামনে নামলাম। ডিসেম্বর মাস, কনকনে শীতের রাত। কালো একটা হুডি পরা ছিল আমার, নাক কান ঢেকে হাটা শুরু করলাম। পুড়ো এলাকা নীরব, মানুষের চলাফেরা নাই বললেই চলে। নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল টা তখনো চালু হয়নি। এর দুই দিন আগেই এই এলাকায় শেরে বাংলা নগর থানা আওয়ামী লীগ এর সভাপতি খুন হয়েছিলেন। পুরো এলাকা এমনিতেই থমথমে অবস্থা। দিনরাত পুলিশের টহল থাকে।
বিজ্ঞান জাদুঘর এর সামনে আসতেই দুই পুলিশ আমাকে থামালো!
– আপনি কে? এতো রাতে কোথায় যান?
– সামনেই আমার বাসা, বাসায় যাইতেছি।
– এতো রাতে কোথায় গেছিলেন?
– শেওড়া পাড়া, মামার বাসায়।
– আপনাকে তো কখনো আগে এই এলাকায় দেখিনাই?
– আমাকে তো আপনাদের দেখার কথা না। আর আমি গত মাসেই এই এলাকায় আসছি।
– কি করেন আপনি?
– ডাক্তার।
– আইডি কার্ড দেখান।
– আইডি কার্ড ত নাই। (তখন আমি নাম পরিচয় বিহীন এক ডাক্তার, কোন চাকরী নাই, তাই আইডি কার্ড ও নাই!)
– তাহলে আমাদের সাথে চলেন।
আমি তখন বিপদের গন্ধ পাওয়া শুরু করছি। যেহেতু কোন অপরাধ করিনাই তাই ভয় পাইনি কিন্তু মনে হচ্ছিল একটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে যাচ্ছি।
ঠিক সেই সময়ে পাশের বস্তির এক ঘর থেকে এক মহিলা ময়লা পানি ফেলতে বাইরে আসে। একজন পুলিশ তাকে জিজ্ঞেস করল-
– এই লোক কে আগে এই এলাকায় দেখছেন? (আমি বিরবির করে বলার চেষ্টা করলাম- এই মহিলা আমাকে চিনবে কেমনে?)
– হ, অনেকদিন ধইরাই তো দেখি, এই রাস্তা দিইয়াই চলাচল করে!!
আমি অবাক হয়ে মহিলার দিকে তাকাইলাম, আলো আধারী র মধ্যে, সাধারন একজন বস্তির মহিলা, কোনদিন দেখছি বলে মনে পড়ল না!
এইবার পুলিশ বলল –
– ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি বাসায় যান। এতো রাতে ঘোরাঘুরি করবেন না।
আমি ধন্যবাদ বলে তাড়াতাড়ি চলে আসলাম। এখনো মাঝে মাঝেই ভাবি – নিতান্তই সাধারন একজন মহিলা, কোন কিছুই না ভেবে আমার জন্য অবলীলায় মিথ্যা কথা বলে আমাকে আসন্য বিপদ থেকে বাচিয়ে দিয়ে গেল। ওই এলাকায় এর পরেও অনেক দিন ছিলাম, কিন্তু কোনদিন ওই মহিলা কে দেখছি বলে মনে পড়েনা। দেখলেও চেনার কথা না। কারণ ওই অন্ধকার রাতেও তার চেহারা আমি ঠিকমত দেখিনাই।